আজ ১৪ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ে সভাপতি হলেন ‘বিতর্কিত’ সেলিম আফজল, তদন্তের নির্দেশ


চাটগাঁর সংবাদ ডেস্ক

চট্টগ্রাম নগরীর দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটিতে বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারী, বিতর্কিত সেলিম আফজলকে সভাপতি করে কমিটি অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা বোর্ড ও জেলা প্রশাসকের কাছে জমির উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির লিখিত অভিযোগ থাকলেও কমিটি অনুমোদনে তা আমলে নেয়নি বোর্ডের কর্মকর্তারা। বোর্ডের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নীতিমালা ১১ এর গ-ধারা অমান্য করে বিতর্কিত সেলিম আফজলের কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগকারীর দাবি, কমিটির অনুমোদনের চুক্তিতে সেলিম আফজল থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়েছে শিক্ষাবোর্ডের উচ্চমান সহকারী (বিদ্যালয় শাখা) এসএম খুরশেদ আনোয়ার। বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী, উপ-পরিদর্শক আবুল বাশার এই টাকায় ম্যানেজ হয়েই বিতর্কিত কমিটির অনুমোদন দিয়েছেন। নিয়ম না থাকলেও একইদিন অভিযোগের তদন্ত টিম গঠন ও কমিটির অনুমোদন দেওয়া তারই দৃষ্টান্ত।

তবে কমিটির অনুমোদনে উচ্চমান সহকারী (বিদ্যালয় শাখা) এসএম খুরশেদ আনোয়ার কোনো টাকা নিয়েছেন কিনা, তা জানা নেই বলে জানান কমিটি অনুমোদনকারী ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী। তার দাবি, নিয়ম মেনে কমিটির অনুমোদন ও তদন্ত টিম করা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনে অনুমোদিত কমিটি বাতিল করা হবে।

এদিকে অভিযোগে বলা হয়, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করা ইপিজেড থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম আফজল ইতোপূর্বেও দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের কমিটি সভাপতি ছিলেন। তখন বিভিন্ন অপকর্ম ও অনিয়ম করায় ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর শিক্ষা বোর্ডে অভিযোগ করেছিলেন বর্তমান নির্বাচিত কমিটির ১ ও ৩ নম্বর অভিভাবক সদস্য সৈয়দ আনোয়রুল করিম ও নাছির উদ্দিন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সেলিম আফজল পুনরায় সভাপতি হতে একটি সাজানো নির্বাচন করার চেষ্টা করেন। এলাকার লোকজন অংশগ্রহণ না করে ভোট বর্জন করায় নির্বাচনটি স্থগিত হয়। বিদ্যালয়ে তার ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে ২০২০সালে ৬ জানুয়ারিতে শিক্ষা বোর্ডে আরও একটি অভিযোগ দায়ের কারেন এলাকর মেম্বার মোতাহের, সেলিম রেজা ও আব্দুর রব। পরে সেলিম আফজলের দুর্নীতি বুঝতে পেরে বিদ্যালয় কমিটি থেকে তাকে অপসারণ করে শিক্ষা বোর্ড। এরপর শাহাব উদ্দিনকে সভাপতি করে বিদ্যালয় পরিচালনায় একটি এডহক কমিটি গঠন করা হয়। পুনরায় কমিটিতে ফিরতে তখন থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বিতর্কিত সেলিম আফজল।

অভিযোগে আরও বলা হয়, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের অনুদান দিয়ে বিদ্যালয়ের দাতা সদস্য হওয়ার নিয়ম থাকলেও কোনো অনুদান ছাড়াই ২০২২ সালে নিজেকে দাতা সদস্য করার দাবি তোলেন সেলিম আফজল। ওই বছরের ১০ অক্টোবর বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বিদ্যালয়ের মান ক্ষুণ্ন করে জালিয়াতির মাধ্যমে তাকে দাতা সদস্য করতে শিক্ষাবোর্ডে দরখাস্ত করেন তিনি। শিক্ষাবোর্ডও কিছু যাচাই না করে তাকে দাতা সদস্য করতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নোটিশ করে। তখন বিদ্যালয়ে অনুদান দেওয়ার কোনো রসিদ দেখাতে না পারায় সেলিম আফজলকে দাতা সদস্য করার সুপারিশটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর কিছুদিন পর (চলিত বছরের ১০ জুন) বিদ্যালয়ের কোনো পদে না থেকেও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার জন্য বোর্ডে একটি আবেদন করে সেলিম আফজল। এসময় একটি আঞ্চলিক ও একটি জাতীয় পত্রিকায় ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট তথ্য দিয়ে বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সংবাদ করাতে সহায়তাও করেন তিনি।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সেলিম আফজলের মতো বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে একজন ষড়যন্ত্রকারী ও বিতর্কিত ব্যক্তিকে সভাপতি হিসেবে প্রস্তাবনাও আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নীতিমালা ১১ এর গ-প্রবিধিতে বলা আছে- সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী বা ইহার সুনাম নষ্ট এরূপ কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে অথবা কোনোভাবে উহার সহায়তা করে এমন কোনো ব্যক্তি সদস্য হবার বা কমিটিতে থাকার অযোগ্য। অথচ কমিটিতে প্রস্তাবিত সভাপতি সেলিম আফজল বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বোর্ডে অভিযোগ এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ে অনিয়ম দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ ফাইল আকারে শিক্ষা বোর্ডে রয়েছে।

কমিটির সভাপতি সেলিম আফজল বলেন, ‘আমি যাতে কমিটিতে আসতে না পারি এজন্য অভিযোগটি করা হয়েছে। ২০১৭ সালে দুই অভিযোগকারী এখন সভাপতি হিসেবে আমাকে প্রস্তাব করা কমিটির নির্বাচিত অভিভাবক সদস্য। তারা আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে এই অভিযোগ করা হয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন। দাতা সদস্য হওয়ার জন্য আমি বিদ্যালয় ফান্ডে দেড় লাখ টাকা দিয়েছি। সবার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল থাকায় তখন আমি রশিদ গ্রহণ করিনি। পরে দাতা সদস্য করার জন্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে বলা হলে তিনি শিক্ষা বোর্ড বা কোর্টে যেতে বলেন। তাই আমি শিক্ষা বোর্ডে গিয়েছিলাম। বোর্ড আমাকে এক মেয়াদের জন্য দাতা সদস্য করেছে।’

জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে শিক্ষাবোর্ডে চিঠি এবং পত্রিকায় প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে সেলিম আফজল বলেন, ‘কমিটির সভাপতি থাকাকালে আমিই বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে বসিয়েছিলাম। তখন আমি কমিটিতে নতুন হিসেবে বুঝতে পারিনি। এখন জানলাম, বিদ্যালয়ে ওনার চেয়ে অনেক জ্যেষ্ঠ ও যোগ্য শিক্ষক আছেন। বোর্ডে আমার অভিযোগের খবর নিয়ে কোন সাংবাদিক পত্রিকার প্রতিবেদন করেছে। এতে আমার কোনো ভূমিকা নেই।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও লাইব্রেরিয়ান শাহাব উদ্দিনের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষক হয়েও গত ১৫ বছর শাহাব উদ্দিন কোনো ক্লাস করান না। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষক করা হলে পদ হারাবেন বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। এই ভয়ে তারা আরও কয়েকজনকে নিয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।’
দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. ইসমাইল বলেন, ‘আমার জানা মতে, সেলিম আফজল বিদ্যালয় ফান্ডে কোনো টাকা দেননি। এখন যদি টাকা দিয়েছেন রশিদ নেননি বলেন, তাহলে আমাদের কি আর বলার থাকতে পারে। অথচ প্রবিধিতে আছে, টাকা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রশিদ গ্রহণ করার।’

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সেলিম আফজল বলেন, ‘আমরা চাইছি, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান শিক্ষক হোক। আমি কমিটিতে আসলে তাদের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও শাহাব উদ্দিনের ক্ষতি হবে মনে করে কিছু লোককে নিয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। দু’চারজন লোক চাইছে আমি কমিটিতে না আসি। তারা ঠিক মতো ক্লাস ও দায়িত্ব পালন করেন না। আমি সভাপতি হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব এমন ভয় করছেন তারা।’

অভিযোগকারী জমির উদ্দিন বলেন, ‘সেলিম আফজলকে বিদ্যালয়ের সভাপতি হিসেবে প্রস্তাব করা নির্বাচিত কমিটিও অযোগ্য। এই কমিটির ১ ও ৩ নম্বর অভিভাবক সদস্য সৈয়দ আনোয়রুল করিম ও নাছির উদ্দিন বোর্ডের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নীতিমালা অমান্য করে নির্বাচন করেছেন। তারা দু’জনই ২০১৭ সালে বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি সেলিম আফজলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নীতিমালা ১১ এর গ-ধারা অমান্য করে নির্বাচন করেছেন। তাছাড়া নির্বাচনে তিনজন অভিভাবক সদস্যকে জোরপূর্বক মনোনয়ন তুলে নিতে বাধ্য করে এই কমিটির নির্বাচিত সদস্যরা।’

জমির উদ্দিন আরও বলেন, ‘বিতর্কিত কমিটির অনুমোদনে সেলিম আফজল শিক্ষাবোর্ডের উচ্চমান সহকারী (বিদ্যালয় শাখা) এসএম খুরশেদ আনোয়ারকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছে। শুনেছি, এক শুক্রবার পতেঙ্গা নেভালে স্বপরিবারে বেড়েতে গিয়ে এ টাকা গ্রহণ করেছেন এসএম খুরশেদ আনোয়ার। টাকা নিয়ে কমিটির অনুমোদনে খুরশেদ আনোয়ার বোর্ডের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে একপর্যায়ে বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী, উপ-পরিদর্শক আবুল বাশারকে ম্যানেজ করেছেন তিনি। এজন্য নিয়ম বহির্ভূতভাবে ড. বিপ্লব গাঙ্গুলী একই দিন কমিটির অনুমোদন ও কমিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত টিম গঠনে করেছেন।’

যোগাযোগ করা হলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের উচ্চমান সহকারী (বিদ্যালয় শাখা) এসএম খুরশেদ আনোয়ার বলেন, ‘দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ের কমিটি অনুমোদনে টাকা নেয়ার কথা সত্য নয়। আমি ওইদিন স্বপরিবারে পতেঙ্গা নেভালে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি কোন টাকা নিইনি।’

চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক ড. বিপ্লব গাঙ্গুলি বলেন, ‘রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) দক্ষিণ হালিশহর উচ্চ বিদ্যালয়ে কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এ কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় বিষয়টি তদন্তে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেলে কমিটি বাতিল ঘোষনা করা হবে।’

অভিযোগ থাকা কমিটির অনুমোদন ও একই দিন তদন্ত কমিটি গঠন কোন নিয়মে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, এতে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের (শিক্ষা বোর্ড) এই ধরনের নিয়ম রয়েছে।’ তথ্যসূত্র: চট্টগ্রাম প্রতিদিন

 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এই বিভাগের আরও খবর